The first era of the national movement
জাতীয় আন্দোলনের প্রথম যুগ
1. জাতীয় কংগ্রেসের আদিপর্ব নরমপন্থীদের অবদান কী ?
উত্তর : আদিপর্বে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের অবদান :
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের আদিপর্বের নেতারা নরমপন্থী নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
>> জাতীয় চেতনার সঞ্চার: নরমপন্থীদের নেতৃত্বেই কংগ্রেস নানা ভাষা ও জাতি অধ্যুষিত জাতীয় বাসীর মধ্যে ব্রিটিশ অপশাসনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে জাতীয় চেতনা সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা: জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় চেতনাকে সুদৃঢ় করে। | বিভিন্ন শহরে কংগ্রেসের অধিবেশনগুলি অনুষ্ঠিত হওয়ায় জাতীয় সংহতি নিবিড় হয়।
> আবেদন-নিবেদন নীতি: জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের কর্মসূচি আবেদন-নিবেদন নীতির মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিল। এ সময়কার কংগ্রেসের নেতৃবর্গ সরাসরি ব্রিটিশের সঙ্গে সংঘর্ষের রাস্তায় না গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ভুলত্রুটিগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
>> সরকারের সমালোচনা: জাতীয় কংগ্রেস ক্রমাগত সরকারি কাজের সমালোচনা করে। এর ফলে ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত স্বরূপটি বুঝতে পারে।
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমযুগের কর্মপ্রচেষ্টাকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে সমালোচনা করেছেন। অশ্বিনী দষ্ট এসময়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনগুলিকে 'তিনদিনের তামাশা' বলে বাচ্চা করেছেন। লালা লাজপত রায়ের মতে-নরমপন্থীরা চেয়েছিলেন রুটি, পেয়েছিলেন পাথর। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র লিখেছেন, ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বীজ বপনের কাল এবং মহিপর্বের নেতারাই সেই কাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করেছিলেন।
2. জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন সম্পর্কে যা জানো লেখ।
উত্তর : জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন :
পটভূমি: বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য ও পরি কংগ্রেসের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। চরমপন্থী সদস্যরা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্রতর করে সরকারকে অচল করে দেওয়ার দাবি তোলেন, কিন্তু নরমপন্থীরা কোনোরকম জঙ্গি আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের কলকাতা কংগ্রেসে চরমপন্থীরা চাপ সৃষ্টি করে চারটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেন, যথা স্বদেশি জাতীয় শিক্ষা। তাদের ভয় ছিল পরবর্তী সুরাট অধিবেশনে নরমপন্থীরা এই প্রস্তাবগুলি নাকচ করে নেবেন। তাই চরমপন্থীরা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেসের মঞ্চ দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বিরোধ চরমে পৌঁছোয়।
সুরাট ভাঙন: সুরাট অধিবেশনে চরমপন্থীরা লালা লাজপত রায়কে সভাপতি করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তিনি এই পদ গ্রহণে রাজি না হলে চরমপন্থীরা তিলককে সভাপতি করার দাবি তোলেন। নরমপন্থীরা বিচক্ষণতার সঙ্গে মধ্যপন্থী নেতা রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি মনোনীত করেন। এতে দুই দলের মধ্যে বিবাদ চরম আকার নেয় এবং তাদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়। ফলস্বরূপ চর কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হন। নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের এই ভাঙন সুরাট ভাঙন (Surat split) নামে পরিচিত।
তাৎপর্য: বড়োলাট লর্ড মিন্টো সুরাট ভাঙনকে কার্যত সরকারের বিজয় বলে পূর্ব প্রকাশ করেন। বস্তুতই নরমপন্থীরা ইংরেজ সরকারের ওপর আস্থা রেখেই সুরাটে এত কঠোর ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই ঘটনা জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। অবশ্য অল্পকালের মধ্যে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সুরাটের ঘটনার ফলে জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি ও নতুন এক যুগের সূচনা ঘটে।
3. লর্ড কার্জন কেন বাংলা ভাগ করেছিলেন ?
উত্তর : লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ :
> বঙ্গভঙ্গ: ভাইসরয় লর্ড কার্জনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে ঘোষিত হয় এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর 'বঙ্গভঙ্গ' কার্যকর হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গভঙ্গগকে 'জাতীয় বিপর্যয়' বলে অভিহিত করেছেন।
কার্জনের যুক্তি: কার্জনের বাংলা ভাগের পিছনে যুক্তি হল—
● প্রথমত, অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের আয়তন খুব বড়ো। একজন গভর্নরের পক্ষে এতবড়ো প্রদেশের শাসনভার বহন করা কষ্টকর।
● দ্বিতীয়ত, কলকাতা থেকে সুদুর পূর্ববাংলাকে ভালোভাবে শাসন করা সম্ভব নয়।
• তৃতীয়ত, আসামের চা বাগানের মালিকরা চা, তেল প্রভৃতি কম খরচে রপ্তানির জন্য আসামের সঙ্গে চট্টগ্রামের সংযুক্তি চাইছেন। তাদের স্বার্থে বলাভঙ্গের প্রয়োজন।
● চতুর্থত, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আসামকে যুক্ত করা হলে আসামে সুদক্ষ প্রশাসন গড়ে উঠবে।
• পঞ্চমত, উড়িষ্যার সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের জন্য বাংলা ভাগের প্রয়োজন।
> প্রকৃত উদ্দেশ্য: বাংলা ভাগের পিছনে কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। যেমন—
(1) ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যমণি বাংলাকে বিভক্ত করে তার শক্তিকে খর্ব করা।
(2) বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা।
(3) আসামের চা বাগানের মালিকদের স্বার্থরক্ষা করা।
(4) ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি কলকাতাকে তার স্বর্ণাসন থেকে নামিয়ে দেওয়া।
4. বাঘাযতীন স্মরণীয় কেন ?
উত্তর : বাঘা যতীন ও বুড়িবালামের যুদ্ধ :
রাসবিহারী বসুর দেশত্যাগের পর বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (যতীন)। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট বাংলার বিপ্লবীরা কলকাতার অস্ত্র ব্যবসায়ী রডা অ্যান্ড কোম্পানির আমদানি করা ৫০টি | মাউজার পিণ্ডল ও ৪৬ হাজার কার্তুজ লুঠ করেছিল। যতীন্দ্রনাথ বিদেশ থেকে আরও অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালান। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাভেরিক, হেনবিএস এবং এ্যানিলারসন নামক তিনটি মহাজে অস্ত্র আনানোর ব্যবস্থা হয়। স্থির হয়, মাভেরিক জাহাজ থেকে গোপনে অস্ত্র নামানো হবে উড়িষ্যার বালেশ্বরে। বাঘা যতীন তাঁর দলবল নিয়ে বালেশ্বর যান।
ইতিমধ্যে জার্মানি থেকে পাঠানো কিছু অর্থ বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা পড়ে এবং সমস্ত তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ফলে ব্রিটিশরা জাহাজ তিনটি বাজেয়াপ্ত করে। বালেশ্বরে পুলিশ বাঘা যতীনের সনে অগ্রসর হয়। বুড়িবালামের তীরে বাঘা যতীন ও তাঁর সহকর্মীরা পুলিশবাহিনীর মুখোমুখি হন। বাঘা যতীন যুদ্ধে সাংঘাতিকভাবে আহত হন। পরে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন (১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খ্রি.)। বাঘা যতীন ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেন।
বুড়িবালামের যুদ্ধে বিপ্লবীদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ ভারতবাসীকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্রের মতে, বুড়িবালামের যুদ্ধ বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা।
5. ভারতের জাতীয় আন্দোলনে বালগঙ্গাধর তিলকের অবদান কী ছিল ?
উত্তর : বালগঙ্গাধর তিলক :
ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন বালগাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০)। তিনি সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মশক্তি দ্বারা স্বরাজ অর্জনের ডাক দেন।
পত্রিকা সম্পাদনা: তিনি মারাঠা' এবং 'কেশরী' নামে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দুটি পত্রিকাই নিরন্তর ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধ ও আলোচনা প্রকাশ করে জাতীয়তাবোধে দেশবাসীকে উদবুদ্ধ করেছিল।
গণপতি ও শিবাজী উৎসব :জনগণের মনে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে তিলক গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসব-কে গণ-উৎসবে পরিণত করেন। স্বদেশি বক্তৃতা, গান, শোভাযাত্রা প্রভৃতির মাধ্যমে এই উৎসব জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশ-চেতনা বৃদ্ধি করে।
> বয়কট আন্দোলনে নেতৃত্ব : তিলকের নেতৃত্বে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন মহারাষ্ট্রে প্রসারলাভ করে। তিলক ঘোষণা করেন বয়কট ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আমাদের অস্ত্র। কারো ওপর বলপ্রয়োগের পক্ষপাতী আমরা নই। কর্মপন্থা অনুসরণ করতে গিয়ে যদি দুঃখবরণ করতে হয় তা হলেও আমরা পিছু হঠব না।
> হোমরুল আন্দোলন: হোমরুল আন্দোলনের মাধ্যমে তিলক রাজ অর্জনের চেষ্টা করেন। তাঁর আহ্বানে বহু যুবক হোমরুল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিলক হোমরুল লিগের মাধ্যমে গণ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি অত্যন্ত দ্রুত এই আন্দোলনকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িে তিলক বলেন—দমন পীড়ন বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে। হোমবুল এখন ছড়িয়ে দাবানলের মতো। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমি তা অর্জন কর (("Swaraj is my birth-right and I must have it")। হোমরুল আন্দোলন ে নেতায় পরিণত করে। তিলক 'লোকমান্য' অভিধায় ভূষিত হন। তিলকের আদর্শ, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ দেশবাসীকে সক্রিয় আন্দোলনে উল্লখ সম্পর্কে অরবিন্দ ঘোষ লিখেছেন তিলকই জাতীয় আন্দোলনকে জনতার কাছে পৌঁছে দেন।
6. বিপ্লবী লালা লাজপত রায় সম্পর্কে কী জানা যায় ?
উত্তর : লালা লাজপত রায়:
(1) লালা লাজপত রায় (১৮৬৫-১৯২৮ খ্রি.) ছিলেন সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা। 'লাল-বাল-পাল'-এর অন্যতম সদস্য। প্রথম জীবনে তিনি আর্যসমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরে তিনি এলাহাবাদের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে (১৮৮৮ খ্রি.) যোগ দেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি নেতারূপে তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করেন।
(2) তাঁর নেতৃত্বে চরমপন্থী আন্দোলন পাঞ্জাবে ব্যাপকতা পায়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের শোষণমূলক ভূমি-রাজস্ব আইনের বিরুদ্ধে এবং অতিরিক্ত জলকরের বিরুদ্ধে তিনি কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাঁকে মান্দালয় জেলে বন্দি করা হয়।
(3) 'কায়স্থ সমাচার' পত্রিকায় তিনি নরমপন্থী রাজনীতির অসারতা তুলে ধরেন। পাঞ্জাবি ভাষায় তিনি ‘পাঞ্জাবি' পত্রিকা প্রকাশ করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।
(4) অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। দেশপ্রেম ও সাহসিকতার জন্য জনগণ তাঁকে শের-ই-পাঞ্চাব (পাঞ্জাব কেশরী) অভিধায় ভূষিত করে।
7. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভাব কী ছিল ?
উত্তর :ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভাব
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
(1) বিপ্লবীদের সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মবলিদানের দৃষ্টান্ত সমগ্র দেশবাসীর মনে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।
(2) ভারতবাসীর মনে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস জাগাতে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী যুবকদের আত্মত্যাগের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
(3) যুবসমাজের আত্মোৎসর্গ দেশের জাতীয় নেতাদের সংগ্রামমুখী কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।বিপ্লববাদী আন্দোলন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে একধাপ এগিয়ে দেয়।
(4) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন এই শিক্ষা দেয় যে—ভারতবাসী যে-কোনো মূল্যে স্বাধীনতা পেতে মরিয়া। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে—তাঁরা আবার আমাদের মনুষ্যত্বের গর্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
(5) এই আন্দোলন ভারতবাসীকে এই শিক্ষা দিয়েছিল যে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার পরিবর্তে আত্ম বিসর্জনের মাধ্যমে হলেও স্বাধীনতা অর্জন প্রয়োজন।
(6) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ভারতের জাতীয় সংগ্রামের মূল ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। বিপ্লবীরা এই আন্দোলন থেকে নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন।
তাই ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, গান্ধিজি পরিচালিত অহিংস আন্দোলন এবং বিপ্লবী আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটি ধারা। এরা ছিল পরস্পরের পরিপূরক।
8. স্বদেশী ও স্বরাজ বলতে কী বোঝো ?
উত্তর : লর্ড কার্জন অন্যায়ভাবে বাংলাকে ভাগ করতে চাইলে সারা বাংলা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। শুরু হয় বলাভলা-বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫ খ্রি.)। এই আন্দোলনে স্বদেশি ও স্বরাজ—এই দুটি গঠনমূলক আদর্শকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবোধ সম্প্রসারিত হয়।
স্বদেশি :
'স্বদেশি' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল দেশীয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় স্বদেশি' কথাটি বহুল প্রচারিত হয়।
(1) ব্রিটিশ সরকারের বলাভলোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হিসেবে দেশে ছি আন্দোলনের জোয়ার আসে।
(2) অবশ্য 'স্বদেশি' আদর্শ ও চেতনা আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিল। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্ে স্বদেশির কথা পুনাতে প্রথম বলেন গোপালহরি দেশমুখ। কলকাতায় মুখার্জিস মাথারিন এ ভোলানাথ চন্দ্র একাধিক প্রবন্ধ রচনা করে স্বদেশি আদর্শকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
(3) ''স্বদেশী হল দেশের ঐতিহ্য ও জীবনধারার প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা।
(4) স্বদেশি সম্পর্কে লালা লাজপত রায় বলেন যে, স্বদেশি মানে দেশের মুক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশি অর্জনের জন্য আত্মশক্তি বিকাশের ওপর জোর দেন।
স্বরাজ :
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় স্বরাজ' কথাটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
(1) জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (১৯০৬ খ্রি.) সভাপতির ভাষণে দাদাভাই নওরোজি জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে 'স্বরাজ' অর্জনের কথা বলেন।
(2) পরবর্তীকালে নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতারা নিজ নিজ আদর্শ অনুযায়ী রাজশ ব্যাখ্যা করেন। নরমপন্থী নেতাদের কেউ কেউ স্বরাজ বলতে ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকে স্বাধিকার অর্জনের কথা বলেন। প্রখ্যাত বিপ্লবী সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯-১৯১২ খ্রি.) ‘স্বরাজ' শব্দটি স্বাধীনতার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। বিপিনচন্দ্র পালের ভাষায় স্বরা হল, ব্রিটিশ শাসনমুক্ত আত্মকর্তৃত্ব।
(3) বালগাধর তিলক বলেন, 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার। তবে তিলকের কাছে স্বরাজ' এর অর্থ ছিল শাসনব্যবস্থার ওপর ভারতীয় নিয়গুণ স্থাপন।
(4) আবার অরবিন্দ ঘোষের বিচারে স্বরাজ ছিল 'নৈতিক' ও 'আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ। জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথমে 'স্বরাজ' বলতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বোঝানো হয়।পরবর্তীকালে 'স্বরাজ' অর্থে 'স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়।
9. জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কাল থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেসের কার্যকলাপ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর: ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রি. পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কার্যাবলি :
প্রতিষ্ঠালাভের পরবর্তী কুড়ি বছর (১৮৮৫-১৯০৫ খ্রি.) জাতীয় কংগ্রেসের আদিপর্ব নামে পরিচিত। এই পর্বের নেতৃবৃন্দ সরকারের বিরুদ্ধে কোনোরূপ গণ আন্দোলন সংগঠিত করার পরিবর্তে 'আবেদন-নিবেদন' মাধ্যমে সরকারের সহানুভূতি অর্জনে আস্থাশীল ছিলেন। এই কারণে প্রথম পর্বের নেতাদের নরমপন্থী (Moderate) নামে অভিহিত করা হয়। কংগ্রেসের আদিপর্বের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দাদাভাই নওরোজি , বদরুদ্দিন তায়েবজী, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সুরেন্দ্রনাথ যন্দ্যাপাধ্যায়, ফিরোজ শাহ মেহতা, আনন্দ চারলু প্রমুখ। ড. রমেশচন্দ্র জুমদারের মত অনুযায়ী, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতবাসীর স্বার্থের প্রহরী ("The Indian National Congress guarded the interests of India like a vigilant watchdog") i
আবেদন-নিবেদন নীতি: প্রথম পর্বের কংগ্রেস নেতাদের এয় সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও পাশ্চাত্য মনোভাবাপন্ন। ইংরেজ-জাতির উরতা ও ন্যায়বোধের ওপর এঁদের গভীর আস্থা ছিল। ধর্ম ও সমাজ সম্বোরের মতোই রাজনীতির ক্ষেত্রেও নরমপন্থীরা ছিলেন অতিসতর্ক শঙ্কারপন্থী। দাদাভাই নওরোজি বলেছিলেন—সদা ব্যস্ত ব্রিটিশ-জাতির কাছে আমরা যদি বলিষ্ঠ কণ্ঠে এবং বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারি, তবে তা অবশ্যই বিফলে যাবে না।
>> লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : প্রথম পর্বের নেতৃবৃন্দ সাংবিধানিক পথে ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ভারতবাসীর দাবি আদায়ের জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালান। কংগ্রেসের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল—(1) জাতিধর্ম নির্বিশেষে ও গণতান্ত্রিক পথে একটি জাতীয় আন্দোলন সংগঠিত করা; (2)ভারতবাসীকে রাজনৈতিকভাবে হন করা; (3) সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দান এবং (4) ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রচার করা।
এজন্য প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক সম্মেলন আহ্বান করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হত। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে–কংগ্রেস ভারতবাসীর ঐকা ও ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব চায়।
> দাবি: প্রথম কুড়ি বছরে কংগ্রেসের দাবিগুলিকে চারভাগে ভাগ করা যায়-রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক।
● রাজনৈতিক দাবি:
(1) রাজনৈতিক দাবির মূল লক্ষ্য ছিল বেশিসংখ্যক ভারতীয়কে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা।
(2) প্রথম অধিবেশনেই কংগ্রেস ভারত-সচিবের দপ্তর বিলোপের দাবি জানায়। ভারত-বিে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওই দপ্তরের বদলে কমল সভায় একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
(3) প্রতি প্রদেশ থেকে অন্তত দুজন করে ভারতীয়কে কমন্স সভায় মনোনয়নের দাবি জানানো হয়।
(4) ব্যবস্থাপক সভায় (Legislative Council) নির্বাচিত প্রতিনিধি বাড়ানোর দাবি করা হয়। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করে।
প্রশাসনিক দাবি:
(1) প্রশাসনিক সংস্কার হিসেবে জাতীয় কংগ্রেস উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ দাবি করে। এই ব্যবস্থা দ্বারা বিদেশে অর্থের বহির্গমন আটকানো এবং দেশের সেবায় দেশীয় মানুষের বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়।
(2)নরমপন্থী নেতারা সংবাদপত্র ও বাতৃস্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হন।
(3) শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ, জুরিব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার আইন বাতিল ইত্যাদি দাবিও তোলা হয়।
(4) ভারতীয়দের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও উচ্চপদে নিয়োগের দাবি জানানো হয়।
অর্থনৈতিক দাবি:
(1) জাতীয় কংগ্রেস বার্ষিক অধিবেশনগুলিতে অর্থসংস্কারের ওপর জোর দেয়।
( 2)ভারত থেকে সম্পদের অবাধ বহির্গমন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।
(3) ভারতের আর্থিক উন্নতির জন্য কংগ্রেস আধুনিক শিল্প-প্রতিষ্ঠার দাবি করে।
(4) শুরনীতি গ্রহণ করে শিল্পের বিকাশ ঘটানোর দাবি জানানো হয়।
(5) কৃষকের ওপর থেকে রাজস্বের ভার কমানোর দাবি করা হয়।
(6) চা-শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি, লবণ করের বিলোপ ইত্যাদি দাবিও কংগ্রেস উত্থাপন করে।
(7) অরণ্য সংরক্ষণ ও আধিবাসীদের ক্ষেত্রে অরণ্য আইন সরল করার দাবি জানানো হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবি: জাতীয় আন্দোলনের আধিপর্বের নেতারা অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সংগ্রাম করেন।
ব্যর্থতা: জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কুড়ি বছরে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে কারেন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সামগ্রিক বিচারে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের কার্যকলাপকে বখই বলা যায়। তবে এই ব্যর্থতার জন্য মূলত দায়ী ছিল ব্রিটিশ-জাতির অনমনীয় মনোভাব ও অসহযোগিতা। নরমপন্থীদের আবেদন-নিবেদন নীতিকে ইংরেজ সরকার কোনো মূল্য দেয়নি। তাই সমপন্থীর নরমপন্থীদের নীতিকে রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি বলে বাল্লা করেন। আসলে তখন কংগ্রেসের খণভিত্তি হতে ছিল না। তাই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব ছিল না।
মূল্যায়ন: আপাত ব্যর্থ হলেও জাতীয় কংগ্রেসকে ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে নরমপন্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র লিখেছেন— ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বীজ বপনের কাল এবং আদিপর্বের নেতারাই সেই কাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করেছিলেন ("The period from 1885-1905 was the seed time of Indian nationalism and the earliest nationalists sowed the seeds well and deep")
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন