ভারতের সুলতানি ও মোগল যুগের ইতিবৃত্ত
History of sultanate and Mughal Era
1. নব মুসলমান কাদের বলা হয়?
উত্তর: ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল বাহিনী ভারত আক্রমণ করলে সুলতান জালালউদ্দিন খলজি তাদের পরাজিত করেন। এই সময় হলাগুর নেতৃত্বে কয়েক হাজার মোঙ্গল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ভারতে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সুলতানের অনুমতি অনুসারে দিল্লির উপকণ্ঠে বসবাসকারী এই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মোঙ্গলরা নব মুসলমান নামে পরিচিত হয়।
2. আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির উদ্দেশ্য কী ছিল ?
উত্তর: আলাউদ্দিন খলজি স্বল্প ও নির্দিষ্ট বেতনে বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না হওয়ায় সৈন্যরা একই বেতনে বছরের পর বছর কাজ করত।
3. মনসবদারি প্রথা কী ?
উত্তর: 'মনসব ' কথাটির আক্ষরিক অর্থ 'পদমর্যাদা'। কুরেশির মতে কার্যকরী অর্থে মনসব এমন একটি পদ ছিল যার সঙ্গে বেশ কিছু নিয়ম ও দায়িত্ব সংযুক্ত হয়। আকবরের আমলে বিশেষ পদমর্যাদাযুক্ত ও দায়িত্বপূর্ণ কর্মচারী নিয়োগের যে প্রথা চালু হয় তাই মনসবদারি প্রথা নামে পরিচিত।
4. নুরজাহান ইতিহাসে বিখ্যাত কেন ?
উত্তর: নুরজাহান ছিলেন জাহাঙ্গীরের পত্নী। তিনি ছিলেন রূপবতী, বুদ্ধিমতী এবং উচ্চাভিলাষীণী। তিনি জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার করায়ত্ত করে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে 'নুরজাহান চক্র' গড়ে তুলেছিলেন।
5. আরব মুসলমানদের সিন্ধু আক্রমণ সম্বন্ধে লেখ।
উত্তর : আরব মুসলমানদের সিন্ধু জয় :
> আক্রমণের কারণ: আরব মুসলমানদের সিন্ধু অঞ্চলে অভিযানের কারণ সম্পর্কে নানা মত আছে। কারো মতে, ইসলামধর্ম বিস্তারের উদ্দেশ্য, কেউ মনে করেন ধনসম্পদ লুণ্ঠন, আবার অনেকে মনে করেন ভারতের বাইরে সামরিক সাফল্য, আরব মুসলমানদের সিন্ধু অভিযানে উৎসাহিত করেছিল।
অনেকে বলেন, সিংহলের রাজা স্বয়ং ইসলামধর্ম গ্রহণ করে খলিফার উদ্দেশ্যে কিছু উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সিন্ধু উপকূলে সেই উপঢৌকন-ভরতি জাহাজ লুষ্ঠিত হয়। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে আরবের শাসনকর্তা হজ্জাজ সিন্ধু না করেছিলেন।
অনেকের মতে, ভারতে ক্রীতদাসী ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করার জন্য খলিফা তার কয়েকজন অনুচরকে ভারতে পাঠান। কিন্তু সিন্ধুর নিকট সমুদ্রপথে আরবের জাহাজটি লুষ্ঠিত হয়। হজ্জাজ সিন্ধু দেশের রাজা দাহিরের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু দাহির তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরিত হয়।
তবে খুব সম্ভবত এই অভিযানের কারণ ছিল এই রকম—সিংহলে মৃত আরব বণিকদের সম্পদ ও তাঁদের কন্যাদের আরবে ফেরত পাঠানোর সময় সিন্ধুর উপকূলে জলদস্যুরা তাদের অপহরণ করে। এতে আরব মুসলমানরা ক্ষুদ্ধ হয়ে সিন্ধু আক্রমণ করেছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের ধারণা।
ঘটনা যাই হোক হজ্জাজের সেনাপতি মহম্মদ-বিন্-কাশিমের নেতৃত্বে আরব মুসলমানরা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্দু আক্রমণ করে। সিন্ধুর রাজা দাহির যুদ্ধে পরাজিত হন। সিন্ধু আরব মুসলমানদের দখলে আসে।
6. কুতুবউদ্দিন আইবকের নাম স্মরণীয় কেন?
কুতুবউদ্দিন আইবক :
মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর (১২০৬ খ্রি.) পর ভারতে তাঁর প্রতিনিধি ও প্রশাসক কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে স্বাধীন সুলতানির সূচনা করেন।
>> দাস বংশের প্রতিষ্ঠা: কুতুবউদ্দিন প্রতিষ্ঠিত বংশ সাধারণভাবে দাসবংশ নামে পরিচিত। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে কুতুবউদ্দিন নিজ শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ইলতুৎমিসের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দেন, সিন্ধুদেশের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচার সঙ্গে ভগ্নীর বিবাহ দেন। তিনি নিজে গজনীর শাসক তাজউদ্দিনের কন্যাকে বিবাহ করেন। এইভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা তিনি বিদেশ-নীতির এক নতুন পথ তৈরি করেন।
কৃতিত্ব :
(i) কুতুবউদ্দিন ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি গজনীর সঙ্গে ভারতের সুলতানি শাসনের সম্পর্ক ছিন্ন করে এদেশে স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
(II) কুতুবউদ্দিন একজন সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। গুজরাটের রাজা ভীমদেব তাঁর হাতে পরাস্ত হন।
(iii) দানশীলতার জন্য কুতুবউদ্দিন লাখবক্স নামে পরিচিত ছিলেন।
(iv) বাগদাদের প্রখ্যাত ধর্মগুরু খাজা কুতুবউদ্দিনের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি দিল্লিতে কুতুবমিনার নির্মাণ শুরু করেন। তবে তিনি এটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি দিল্লি ও আজমীরে দুটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
১২১০ খ্রিস্টাব্দে চৌগান খেলার সময় কুতুবউদ্দিন দুর্ঘটনায় মারা যান। ঐতিহাসিক হাবিবউল্লাহ ন মতে, কুতুবউদ্দিনের মধ্যে তুর্কিজাতির সাহসিকতা ও পারসিকদের উদারতা এবং রুচিবোধের সমন্বয় ঘটেছিল।
7. সুলতানা রাজিয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সুলতানা রাজিয়া :
সুলতান ইলতুৎমিস মৃত্যুর পূর্বে নিজ কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু সুলতানের মনোনয়ন অগ্রাহ্য করে অভিজাতরা ইলতুৎমিসের পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। রুকনউদ্দিন ফিরোজের অযোগ্যতার জন্য চারদিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে রাজিয়া অযোগ্য রুকনউদ্দিন ফিরোজকে হত্যা করে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
>> কৃতিত্বঃ রাজিয়া তাঁর সাড়ে তিন বছরের রাজত্বে প্রশাসক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন।
(1) সিংহাসনে বসেই তিনি চারিদিকের বিশৃঙ্খলা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
(2) ব্যক্তিগতভাবে রাজকার্য পরিচালনা করা, নিয়মিত দরবারে উপস্থিত থেকে অভাব অভিযোগের নিষ্পত্তি করা, ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা ইত্যাদি সমস্ত কাজেই তিনি পুরুষের সমান দক্ষতা দেখান। তিনি নিজ মুদ্রায় সুলতান শব্দ ব্যবহার করতেন।
(3) তিনি চল্লিশ চক্র বা বন্দেগান-ই-চাহেলগান নামে পরিচিত অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ভোগকারী তুর্কি অভিজ্ঞাতদের ক্ষমতা খর্ব করতে উদ্যোগী হন।
রাজিয়ার পুরুষসুলভ আচরণ এবং ইয়াকৎ নামে এক হাবসী অনুচরের প্রতি অতিরিক অনুগ্রহ প্রদর্শন তুর্কি আমীরনের ঊর্যা ও বিরক্তির কারণ হয়। এ ছাড়া তারা নারীর শাসন অপমানজনক মনে করে। তাই তৎকালের মধ্যে অভিজাতরা রাজিয়ার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হন এবং তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। রাজিয়া বিদ্রোহী আমীরদের এক নেতা আলকুনিয়াকে বিবাহ করে অভিজাতদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে উভয়েই বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
8. বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ কীরূপ ছিল ?
বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ :
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য আত্মনিয়োগ করেন।
(1) বলবন নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে অভিহিত করেন।
(2) জনসাধারণের মনে ভীতি উৎপাদনের জন্য তিনি উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত বিশালদেহী সশস্ত্র দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে রাজোচিত গাম্ভীর্য সহকারে দরবারে আসতেন।
(3.) তিনি দরবারে হাস্যপরিহাস, আমোদপ্রমোদ, মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন।
(4) নিজেকে তিনি পারসিক বীর আফ্রাসিয়ারের বংশধর বলে দাবি করেন।
(5) পারস্যের অনুকরণে পাইবস অর্থাৎ সম্রাটের পদচুম্বন করা; সিজদা অর্থাৎ সিংহাসনের সামনে নতজানু হওয়া ইত্যাদি প্রথা চালু করেন।
(6) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। অপরাধ করলে অভিজাত বা আত্মীয়কেও তিনি ক্ষমা করতেন না। জনৈক অভিজাত ব্যক্তি তার ক্রীতদাসের ওপর অত্যাচার করেছিল। বলে বলবন সেই ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করেছিলেন।
9. আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য নীতি আলোচনা করো।
দাক্ষিণাত্য নীতি:
উত্তর ভারত বিজয়ের পর আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারত বিজয়ে উদ্যোগী হন। আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্রা অভিযানের পিছনে মূলত নিম্নলিখিত কারণগুলি কাজ করেছিল।
(1) আলাউদ্দিন ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তিনি আলেকজান্ডারের মতো দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন দেখতেন এবং এক বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। সেই বিশাল সৈন্যবাহিনী আলাউদ্দিনকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রলুদ্ধ করে।
(2) সেই সময় দক্ষিণ ভারতে চারটি সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। যথা—দেবগিরির যানব রাজা, তেলেঙ্গানার কাকতীয় রাজ্য, হোয়সল রাজ্য ও পাণ্ডা রাজ্য। এই রাজ্যগুলি পরস্পর বিবাদে লিপ্ত ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে এই অনৈক্য আলাউদ্দিনকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে উৎসাহিত করেছিল।
(3) দক্ষিণ ভারতের অফুরন্ত ঐশ্বর্য আলাউদ্দিনকে আকৃষ্ট করেছিল।
(4) জালালউদ্দিনের রাজত্বকালে দেবগিরি দিল্লিকে বাৎসরিক কর দিত। এই কর দিলে তা আদায় করার জন্য আলাউদ্দিন দাক্ষিণাতা অভিযান করেন।
অভিযান: আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাতা অভিযানে নেতৃত্ব দেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাকুর। দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো বার্ষিক কর দেওয়া বন্ধ করলে আলাউদ্দিন ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুরকে দেবগিরির বিরুদ্ধে পাঠান। দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করেন। ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুর বরলালের কাকতীয় বংশীয় রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্রকে আত্মসমর্পণে ধ্যে করেন। ১০১০ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুর হোয়সল রাজ্য অতর্কিতে আক্রমণ করে হোয়সলরাজ তৃতীয় ইরবালকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে কাফুর পাণ্ডা রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সহজেই করেন। তিনি সেতুবন্ধ রামেশ্বরম পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন। (১০১৩ খ্রিস্টাব্দে কাকুরকে পুনরায় দেবগিরির বিরুদ্ধে পাঠানো হয়। রামচন্দ্রের পুত্র শঙ্কর পিতৃ-প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী করদান বন্ধ করে দিলে কাফুর শঙ্করকে পরাজিত ও নিহত করেন। দেবগিরিতে দিল্লির প্রভুত্ব সমাপন করে কাফুর হোয়সল রাজ্য দিল্লির সাম্রাজ্যভুত্ব করেন।
এইভাবে ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে আলাউদ্দিন সমগ্র দক্ষিণ ভারতে নিজ প্রভুত্ব স্থাপন করেন।
10. আকবরের রাজপুত নীতি কী ছিল ?
আকবরের রাজপুত নীতি :
আকবরের রাজপুত নীতির মূল লক্ষ্য ছিল রাজপুতদের আনুগত্য লাভ করে মোগল শাসনকে ভারতীয় চরিত্র দেওয়া।
আকবর রাজপুতদের আনুগত্য লাভের জন্য নিম্নলিখিত নীতি গ্রহণ করেন।
● বৈবাহিক সম্পর্ক দ্বারা বশ্যতা আদায়: আকবর নিজে অম্বররাজ বিহারীমলের কন্যা যোধাবাঈকে বিয়ে করেন এবং নিজপুত্র সেলিমের সঙ্গে ভগবানদাসের কন্যার বিবাহ দিয়ে রাজপুতদের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিহারীমল, ভগবানদাস, মানসিংহ প্রমুখ রাজপুতদের উচ্চপদ দান করে তিনি রাজপুতদের আনুগত্য লাভ করেন।
অম্বরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মারওয়াড়, বিকানীর, বুন্দি,রণথস্তোর, কালিপ্তর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্য আকবরের বশ্যতা মেনে নেয়।
2. শক্তি প্রয়োগ: শিশোদীয় বংশের রানা উদয়সিংহ মেবারের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন। আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রাজধানী চিতোর অবরোধ করেন। রানা উদয়সিংহ জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
উদয়সিংহের পর তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ মেবারের স্বাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট হন। আসফ খাঁ ও মানসিংহের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী হলদিঘাটের যুদ্ধে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রানা প্রতাপকে পরাজিত করে। অতঃপর রানা প্রতাপ জঙ্গলে আত্মগোপন করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কয়েকটি দুর্গ দখল করতেও সক্ষম হন।
> ফলাফল: আকবরের রাজপুতনীতির ফলে রাজপুত শৌর্য, শাসনপ্রতিভা ও কূটনৈতিক দক্ষতা তাঁর রাজ্যরক্ষায় নিয়োজিত হয়। সর্বোপরি আকবরের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জাতীয় নীতি রাজপুত নীতির মাধ্যমে সূচিত হয়।
11. শিবাজীর অভিষেক সম্পর্কে টীকা লেখ।
শিবাজীর অভিষেক :
শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির উত্থান ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শিবাজী দক্ষিণ ভারতে মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে নিজের অভিষেক সম্পন্ন করেন।
(1) আগ্রা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর শিবাজী শাসনব্যবস্থা সংগঠিত করার কাজে মন দেন। ঔরঙ্গজেবও এই সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতের উপজাতি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই তিনি শিবাজীকে রাজা উপাধি দান করেন (১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। শম্ভুজীকে পাঁচ হাজারী মনসবদার পদে নিযুক্ত করেন। তবে পুরন্দরের সন্ধিতে পাওয়া দুর্গগুলি তিনি শিবাজীকে ফিরিয়ে দেননি। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী পুনরায় মোগলদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। তিনি একে একে পুরন্দর, কল্যান, সিংহগড় দুর্গগুলি উদ্ধার করেন। জিঙি, ভেলোর, কর্ণাটকের কিছু অংশ তিনি অধিকার করেন। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী দ্বিতীয়বার সুরাট বন্দর লুণ্ঠন করেন। কিন্তু তখনও তিনি স্বাধীন রাজা হিসেবে স্বীকৃত হননি। তত্ত্বগত দিক থেকে তাঁর পরিচয় ছিল, তিনি মোগলদের অধীন একজন প্রজা ও জায়গীরদার মাত্র। এ ছাড়া তাঁর উত্থানে মারাঠাদের অন্যান্য গোষ্ঠী ঈর্ষান্বিত হয়। তাই তারা শিবাজীকে রাজা বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না। অথচ নিজেকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ‘রাজা' উপাধির প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁর সভাসদরা ভেবেছিলেন। এই কারণে রাজ্যাভিষেকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
(2) ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড় দুর্গে তিনি নিজের অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। শিবাজী ছত্রপতি ও গো-ব্রাহ্মণ-প্রজাপালক উপাধি গ্রহণ করেন।
12. মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা রূপে বাবরের কৃতিত্ব বর্ণনা করো।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা রূপে বাবরের কৃতিত্ব:
ভারতে মুসলমান শাসনের দ্বিতীয় পর্বের বা মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। শুরু হয় ভারত-ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
1. পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাড: দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে পাঞ্জাবের শাসন কর্তা দৌলত খাঁ-র বিরোধ দেখা দিলে দৌলত খাঁ ইব্রাহিমকে জব্দ করার জন্য বাবরকে ভারত-আক্রমণের প্ররোচনা দেন। বাবর কালবিলম্ব না করে কি বাহিনীসহ ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদি বাবরকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। পানিপথের প্রান্তরে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয় (১৫২৬ খ্রি.)। এটি 'পানিপথের প্রথম যুদ্ধ' নামে পরিচিত। যুদ্ধে ইব্রাহিমকে হত্যা করে বাবর দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।
2.খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাড: পরের বছরেই বাবর মেবারের রানা সংগ্রামসিংহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ১৫২৭-এর ১৬ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়। রাজপুতগণ অসম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও পিছু হটতে বাধ্য হয়। রানা সঙ্গ কোনোক্রমে পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
3. ঘর্ঘরার যুদ্ধে জয়লাভ: রাজপুতদের শক্তি খর্ব করার পর বাবর আফগানদের প্রতি নজর দেন। তখন ইব্রাহিম লোদির ভাই মামুদ লোদি আফগান সর্দারদের সংঘবদ্ধ করে বাবরের বিরোধিতা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পাটনার উত্তরে গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদীর সংগমস্থলে মোগল ও আফগান বাহিনীর সংঘর্ষ হয় (১৫২৯ খ্রি.)। ঘর্ঘরা যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের একবছর পর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবর মৃত্যুবরণ করেন।
>> মূল্যায়ন: মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারূপে বাবরের নাম ভারত-ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। (i) ভারতের প্রতিষ্ঠিত শক্তি আফগান ও রাজপুতদের পরাজিত করে তিনি সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন। সুলতানি শাসনের ভাঙন ভারতের রাজনীতিতে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, বাবর তার অবসান ঘটান।
13. আকবরের উত্তর ভারত বিজয়ের বিবরণ দাও।
আকবরের উত্তর ভারত বিজয় :
দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে জয়ের চার বছরের মধ্যে বৈরাম খাঁ-র নেতৃত্বে আকবর গোয়ালিয় আজমীর, জৌনপুর দখল করে নেন। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বৈরাম খাঁ-র পতনের পর আকবর তাঁর রাজ্যবি নীতির সূচনা করেন।।
> মালব: ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে আদম খান ও পীর মহম্মদের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী মালয়ে সুলতান রাজবাহাদুরকে পরাস্ত করে মালব অধিকার করে। কিন্তু পীর মহম্মদের দুর্বলতার সুযোগে বাজবহর মালব পুনরুদ্ধার করেন। পুনরায় আকবরের সেনাপতি আবদুল্লা খান উজবেগ বাজবাহাদুরকে চূড়ান্তভাবে প্রশ্ন করে মালব অধিকার করেন। মালবে আকবরের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
★ গণ্ডোয়ানা: ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সেনাপতি আসফ খাঁ গড়কাতালা বা গন্ডোয়ান জয় করেন। রানি দুর্গাবতী অসম সাহসিকতার সঙ্গে মোগল বাহিনীকে বাধা দিয়েও পরাজয় বরণ করবে বাধ্য হন।
> অম্বর: আকবর রাজপুতদের প্রতি প্রথমে আত্মীয়তা ও মিত্রতা স্থাপনের নীতি নেন। অম্বরের রাজা বিহারীমল বিনাযুদ্ধে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। আকবর বিহারীমলের প্রস্তাবে তাঁর কন্য মানবাঈকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। তিনি বিহারীমলকে পাঁচহাজারি মনসবদার নিযুক্ত করেন এবং তাঁর পূর ভগবানদাস এবং পৌত্র মানসিংহ ও উচ্চরাজপদ দান করেন।
> অন্যান্য রাজ্য: অম্বরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মারওয়াড়, বিকানীর, বুন্দি, রণথস্তোর, কালিঞ্জর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্যও আকবরের বশ্যতা মেনে নেয়।
মেবারের প্রতিরোধ: মেবার বিনা যুদ্ধে মোগলের বশ্যতা মেনে নিতে অস্বীকার করে। শিশোদীয়া বংশের রানা উদয়সিংহ মেবারের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন। আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে মেবার আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে রানা উদয়সিংহ জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
উদয়সিংহের পর তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ মেবারের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করেন। আসফ খাঁ ও মানসিংহের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী। হলদিঘাটের যুদ্ধে রানা প্রতাপকে পরাজিত করে (১৫৭৬ খ্রি.)। অতঃপর প্রতাপ জালে আত্মগোপন করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যান।
এরপর আকবর গুজরাট, বাংলা, কাবুল, কান্দাহার, কাশ্মীর, বালুচিস্তান ও সিন্ধু জয় করেন। এই জয়ের ফলে সমস্ত উত্তর ভারতে মোগল অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন